অপসঙ্গতির কারণসমূহ লেখাে –
উত্তরঃ – অপসঙ্গতি ব্যক্তিজীবনে একটি জটিল সমস্যা। অপসঙ্গতির প্রধান কারণগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—(১) নিদানমূলক কারণ এবং (২) উপস্থিত কারণ।
* (১) নিদানমূলক কারণ :
সাধারণত জন্মের সময় থেকেই এগুলি দেখা যায়। নিদানমূলক কারণগুলি হল—
>(ক) জিনগত ত্রুটি : জিন বিজ্ঞানীগণ জিনের মধ্যে কতকগুলি উপাদান আবিষ্কার রছেন যা অপসঙ্গতির কারণ।
>(খ) দৈহিক পীড়ন : ব্যক্তি যদি দৈহিক পীড়নের শিকার হয় তাহলেও তার মধ্যে সঙ্গতিবিধান হয় না। দৈহিক পীড়ন এক অসুস্থ মনের জন্ম দেয়। যা থেকে সে কোনােভাবেই বাইরে আসতে পারে না।
>(গ) শারীরিক গঠন : দৈহিক বৈশিষ্ট্য অনেক সময় তার অপসঙ্গতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন যে শিশু সুশ্রী নয়, দুর্বল রা যার কোনাে দৈহিক ত্রুটি আছে তাকে সবাই করুণার চোখে দেখে। তার প্রতি সাধারণের এই দৃষ্টিভঙ্গি তার মনে হীনমন্যতাবােধ সঞ্চার করে। এর ফলে ধীরে ধীরে তার মধ্যে অপসঙ্গতি দেখা দেয়।
* (২) উপস্থিত কারণ :উপস্থিত কারণগুলি হল—
>(ক) সামাজিক কারণ : সামাজিক কারণগুলি হল—
(i) ধর্মীয় বিশ্বাস : শিক্ষার্থরা বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিক্ষণের কিশােরগণ। প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাসকে বর্তমান বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার নিরিখে বিচার করতে
চায়। যখন বিশ্বাসকে তারা যুক্তি দিয়ে সমর্থন করতে পারে না তখন তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয় এবং অনেক সময় অপসঙ্গতিমূলক আচরণের কারণ হয়ে ওঠে।

(ii) অবসর বিনােদনের অভাব : দৈহিক ও মানসিক চাহিদার জন্য। শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিনােদনের প্রয়ােজন। এই চাহিদা পূরণের জন্য।
ন্যূনতম পরিকাঠামাে থাকা প্রয়ােজন। এই চাহিদা পূরণ না হলে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয় যা অপসঙ্গতিমূলক আচরণের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ লাভ করে।
(iii) গতিশীলতা : যে সমস্ত শিশুর পিতামাতা বিভিন্ন কারণে প্রায়ই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বাসস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হন তারা নানান রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়।
(iv) বৃত্তি সম্পর্কিত নিরাপত্তাবােধের অভাব : বয়ঃসন্ধিক্ষণের কিশােরেরা তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব সচেতন হয়। আগামী দিনে বৃত্তির মাধ্যমে আর্থিক নিরাপত্তা অর্জন করতে চায়। যখন তারা চাকরির সুযােগ দেখতে না পায় তখন তারা অস্থির হয়ে পড়ে, তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে হতাশার প্রতিক্রিয়া হিসাবে তারা সমাজের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।
(খ) বিদ্যালয় ঘটিত কারণ : বিদ্যালয় ঘটিত কারণগুলি হল—
(i) বিদ্যালয়ের পরিবেশ : বিদ্যালয়ে আবহাওয়া যদি অস্বাস্থ্যকর ও অস্বাচ্ছন্দ্যকর হয়, আলাে বাতাসের অভাব ঘটে, শ্রেণিকক্ষ যদি ছাত্রসংখ্যা।
অনুযায়ী না হয় সেক্ষেত্রে ছাত্রদের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এই ধরনের অবস্থা পরােক্ষভাবে অপসঙ্গতিকে ত্বরান্বিত করে।
(ii) ত্রুটিপূর্ণ পাঠক্রম : ব্যক্তির বিকাশের বিভিন্ন স্তরে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক চাহিদার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পাঠক্রম রচিত হয় না। ফলে।
পাঠক্রম শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণে অসমর্থ। এই চাহিদা পূরণের অভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে অপসঙ্গতিমূলক
আচরণের মধ্য দিয়ে।
(iii) শ্রেণিকক্ষ : শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন জাতের, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক শ্রেণির ছাত্র থাকে। এরা যদি একত্রে না থেকে বিভিন্ন উপদলে
বিভক্ত হয় তাহলে নিজেদের মধ্যে অশান্তি দেখা দেয়।
(iv) পরামর্শদানের অভাব : শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষা কর্মসূচিতে পরামর্শদান একটি গুরুত্বপূ কর্মসূচি হিসাবে বর্তমানে বিবেচিত।
দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়েই পরামর্শদানের সুযােগ না থাকায় ছােট ছােট সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়ে বৃহৎ আকার ধারণ করে অপসঙ্গতিতে পর্যবসিত হয়।
(v) মূল্যায়ন পদ্ধতি : মূল্যায়ন শিক্ষা প্রক্রিয়ার একটি অপরিহার্য স্তর। কিন্তু বর্তমানে ভ্রান্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মনের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি
করে। শিক্ষার্থীদের উপর মানসিক চাপ এত বেশি থাকে যে অনেক সময় পরীক্ষার ফল আশানুরূপ না হলে তারা আত্মহত্যা পর্যন্ত করে।
>(গ) শিক্ষকগত কারণ : শিক্ষকগত কারণগুলি হল—
(i) প্রশিক্ষণের অভাব : উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে শিক্ষক শিশুর মনােবিজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকার ফলে শিশুর বিকাশে সদর্থক ভূমিকা
পালনে শিক্ষক ব্যর্থ হন। ফলে অপসঙ্গতিমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ তিনি প্রতিহত করতে পারেন না।
(ii) শিক্ষক শিক্ষার্থী সম্পর্ক : শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে তিক্ত সম্পর্ক অনেক সময় অপসঙ্গতিমূলক আচরণের কারণ হয়। শ্রেণিকক্ষে বিশৃঙ্খলা দেখা
দেয়। যে নিরাপত্তা শিক্ষকের নিকট শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশা করে তার অভাব ঘটে। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপসঙ্গতিমূলক আচরণ অস্বাভাবিক নয়।
(iii) কঠোর শাসন : শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষকের। কঠোর শাসন অপসঙ্গতিমুলক আচরণের জন্ম দেয়। শিক্ষক শাস্তি দেওয়ার।
পুর্বে অন্যায় আচরণের কারণ অনুসন্ধান করেই শাস্তির মাত্রা ঠিক করবেন। অন্যথায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষক সম্পর্কে অবাঞ্ছিত মনােভাব সৃষ্টি হয় যা
অপসঙ্গতিমুলক আচরণের কারণ হয়ে ওঠে।
(iv) পক্ষপাতমূলক আচরণ : শিক্ষকের পক্ষপাত মূলক আচরণ অপসঙ্গতিমূলক আচরণের অন্যতম কারণ।
>(ঘ) পারিবারিক কারণ : পারিবারিক কারণগুলি হল—
(i) সন্তানদের প্রতি পিতামাতার দৃষ্টিভঙ্গি : সন্তানের প্রতি পিতা মাতার দৃষ্টিভঙ্গি অনুকূল না হলে সন্তানের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব, অসহায়তা
এবং একাকীত্বের মনােভাব গড়ে ওঠে, যার ফলে তারা অপসঙ্গতির শিকার হয়।
(ii) পিতামাতার আচরণ : পিতামাতার আচরণ যদি সামাজিক মানদণ্ড অনুযায়ী না হয় সেক্ষেত্রে তাদের সন্তানের আচরণের মধ্যে বিকৃতি দেখা দিতে পারে।
(iii) বিপর্যস্ত পরিবার : পিতামাতার মধ্যে যদি ভালােবাসা না থাকে বা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে সেক্ষেত্রে শিশু অপসঙ্গতি বিশিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা
অধিক।
(iv) অতিরিক্ত আদর : পিতামাতার অতিরিক্ত আদর পেয়ে শিশুরা দাম্ভিক, আত্মকেন্দ্রিক হয়। পরবর্তীকালে অসামাজিক এবং অহংকারী ব্যক্তিতে
পরিণত হয়। পিতামাতার আদরের গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকায় বাস্তব সম্পর্কে তাদের কোনাে ধারণাই থাকে না। তাই প্রয়ােজনে সে গৃহ পরিবেশের বাইরে
সঙ্গতিসাধন করতে পারে না।
(v) দারিদ্র্য : গবেষণায় দেখা গেছে অপসঙ্গতিবিশিষ্ট শিশুদের একটি। বড় অংশ আসে নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। নিম্নবিত্ত পরিবারে পিতামাতা শিশুদের ন্যূনতম বৈধ চাহিদাগুলি পূরণে অসমর্থ। অতৃপ্ত চাহিদা শিশুকে অপসঙ্গতিবিশিষ্ট করে তােলে।
উপসংহার
এই পোস্টে, আমরা আপনাকে “ অপসঙ্গতির কারণসমূহ লেখাে ” -এর সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আশা করছি এই পোস্টটি আপনাদের ভালো লাগবে, আর আপনার যদি এই পোস্ট সম্পর্কিত কোনও প্রশ্ন থাকে তবে আপনি আমাদের কমেণ্টের মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।